মাছ ও চিংড়ির রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা

গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম পোনা মজুদ পদ্ধতি, পোনার প্রজাতি নির্বাচন ও মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ এবং পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এ পর্বে আমরা আলোচনা করব মাছ ও চিংড়ির রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

মাছ ও চিংড়ি চাষে জলাশয়ের প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বা বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর আক্রমণের জন্য মাছ ও চিংড়িতে নানারকম রোগ-বালাই দেখা দেয়। রোগ-বালাই হলে মাছ ও চিংড়ির মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায় এবং অনেক সময় মড়ক শুরু হয়, এছাড়াও দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে গিয়ে উৎপাদন কমে যায়, যার ফলে চাষীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন।

মাছ ও চিংড়িকে রোগ-বালাই মুক্ত রাখতে আমাদের জলাশয়ের রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানা খুবই প্রয়োজন। রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদেরকে মাছ ও চিংড়ির রোগ-বালাইয়ের উৎপত্তির কারণ, রোগাক্রান্ত মাছ ও চিংড়ি চেনার উপায় এবং রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে।

মাছ ও চিংড়ির রোগ-বালাইয়ের উৎপত্তির কারণ
জলাশয়ের পানির পিএইচ খুব কম বা বেশি হওয়া, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন হ্রাস পাওয়া এবং পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বা কম হওয়া।
জলাশয়ে পরজীবী ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংক্রমণ যেমনঃ ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া ইত্যাদি।
জলাশয়ের তলায় পঁচা জৈব পদার্থ ও বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি যেমনঃ অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, নাইট্রাইট, নাইট্রেট ইত্যাদি।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও খাদ্য প্রয়োগ।
বাইরে থেকে দূষিত পানির প্রবেশ।
অধিক ঘনত্বে মজুদ।
প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব।
ত্রুটিপূর্ণ পরিবহণ।

রোগাক্রান্ত মাছ ও চিংড়ি চেনার উপায়
ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং ছন্দহীনভাবে পানির উপর সাঁতার কাটে।
খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয় বা একেবারে বন্ধ করে দেয়।
পানির উপর ভেসে খাবি খায়।
শরীরের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে।
ফুলকার স্বাভাবিক রঙ নষ্ট হয়ে যায়।
দেহের উপর লাল/কালো/সাদা দাগ পড়ে।
দেহ খসখসে হয়।
মাছ পানির তলদেশে কোন কিছুর সাথে গা ঘষতে থাকে।
চোখ ফুলে যায় এবং বাইরের দিকে বের হয়ে আসে।
দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে না।
অস্বাভাবিক আচরন করে বা শরীরে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।

মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার

চাষের শুরু থেকে মাছ বা চিংড়িতে কোন রকম রোগ-বালাই যেন না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাকে রোগ-বালাই প্রতিরোধ বলে। অপরদিকে, রোগ-বালাই দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর মাছ বা চিংড়িকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলাই রোগ-বালাই প্রতিকার। মাছ বা চিংড়ির রোগ-বালাইয়ের প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ প্রতিকার করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাই মাছ ও চিংড়ির রোগ-বালাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। জলাশয়ে মাছ/চিংড়িতে যেন কোন রোগ-বালাই না হয় তাই পুকুর বা ঘের প্রস্তুতির সময় থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।

মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধে করণীয়
পোনা ছাড়ার আগে সঠিকভাবে জলাশয় প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশে) ৬-৮ কেজি হারে জারফা, ৩ কেজি হারে জামি, ৫০ মিলি হারে তারা প্রয়োগ করার পর ২৫ গ্রাম হারে ফাতাহ এবং ৩০ গ্রাম হারীয প্রয়োগ করতে হবে।
জলাশয়ে দিনে কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা সূর্যের আলো পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিদিন মাছ/চিংড়ি চাষের জলাশয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং জলাশয়ের অবস্থা বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জলাশয়ে অতিরিক্ত বা বেশি সংখ্যায় পোনা ছাড়া যাবে না।
সব সময় প্রাকৃতিক খাবারের যোগান নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়মিত ও পরিমিতভাবে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে এবং পরিমিত পরিমাণ জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
রোগাক্রান্ত জলাশয়ে ব্যবহার করা জাল ও অন্যান্য উপকরণ ভাল জলাশয়ে ব্যবহার করা যাবে না এবং রৌদ্রে ভালভাবে জাল শুকিয়ে জলাশয়ে ব্যবহার করতে হবে।
বাইরের ময়লা ও দূষিত পানি চাষের জলাশয়ে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না।

এ সকল রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশে) ৩-৫ ফুট পানিতে ২ কেজি জামি, ৫০ মিলি তারা, ২৫ গ্রাম ফাতাহ ও ৩০ গ্রাম হারীয মাসে একবার এবং প্রতি কেজি খাবারের সাথে ৩ গ্রাম তাযিজ ও ৭ মিলি মাশা ব্যবহার করলে জলাশয়ের মাছ ও চিংড়ি রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

এ ছাড়া রোগ প্রতিকারের জন্য প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশে) ৩-৫ ফুট পানিতে ২ কেজি জামি, ১০০ মিলি তারা, ৫০ গ্রাম ফাতাহ ও ৬০ গ্রাম হারীয এবং প্রতি কেজি খাবারের সাথে ৩ গ্রাম তাযিজ ব্যবহার করতে হবে। অবস্থাভেদে প্রয়োগমাত্রা কম বা বেশি হতে পারে। প্রয়োজনে মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

মাছ ও চিংড়ি চাষে পুকুর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে চাষের প্রতিটি পর্যায়ে পানি ও মাটির ব্যবস্থাপনা এবং রোগ-বালাই প্রতিরোধ অত্যন্ত জরুরী। এজন্য নিয়মিত ইনতেফার পণ্য সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করলে মাছ ও চিংড়ি চাষে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।