মাছ ও চিংড়ির শীতকালীন পরিচর্যা

শীতকালীন সময়ে পরিবেশগত নানাবিধ প্রতিকূলতার জন্য মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। এ কারণে শীতকালে মাছ ও চিংড়িতে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, এমনকি মাছ ও চিংড়িতে মড়ক দেখা দিতে পারে।

মাছ ও চিংড়ির শীতকালীন সময়ে সমস্যা ও কারণসমূহ

মাছ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী হওয়ায় এটি নিজের শরীরের তাপমাত্রা নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একারণে মাছের শরীরের তাপমাত্রা এর আশপাশের পরিবেশের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ গরমকালে মাছের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং শীতকালে মাছের শরীরের তাপমাত্রা কম হয়।

সাধারণতঃ পরিবেশের তাপমাত্রা ১° সেলসিয়াস কমে গেলে মাছের মেটাবলিজম বা বিপাকক্রিয়া ১০% কমে যায়। একারণে শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে মাছের খাওয়ার পরিমাণ কমে যায়। ফলে, এদের পুষ্টির চাহিদা ঠিকমত পূরণ হয় না। এছাড়াও বিপাকক্রিয়া কমে যাওয়ার কারণে এদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো (শ্বসন, খাদ্য বিপাকক্রিয়া, হজম প্রক্রিয়া ইত্যাদি) ঠিকমত সম্পাদিত হয় না। ফলে মাছ ও চিংড়ি অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নানাবিধ রোগ জীবাণু দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

আবার কিছু কিছু রোগ জীবাণুর বৃদ্ধির জন্য কম তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়, যেমন গোল গোল ক্ষতরোগ (Epizootic Ulcerative Syndrome-EUS)। শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে এসব রোগ জীবাণু তাদের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ পায়। ফলে শীতকালে মাছের এই সকল ভয়াবহ প্রাণঘাতী রোগ জীবাণু অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

সাধারণতঃ তাপমাত্রার উপর পুকুরের পানির বিভিন্ন প্যারামিটার যেমন অ্যামোনিয়া, pH, দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) ইত্যাদির মান নির্ভর করে। তাপমাত্রা কম হলে পুকুরের পানির pH এর মান কমার পাশাপাশি অ্যামোনিয়ার মাত্রাও সাধারণত কম হয়। পক্ষান্তরে, তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পুকুরের পানির pH এর মান যেমন বেড়ে যায় তেমনি অ্যামোনিয়াসহ ক্ষতিকর গ্যাসসমূহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়) অন্যদিকে শীতকালে রোদ কম থাকায় সালোকসংশ্লেষণ কম হয়, ফলে পুকুরে অক্সিজেনও কম তৈরি হয়। এভাবে পরিবেশের প্রভাবে শীতকালে পুকুরের স্থিতিমাপগুলোর (অ্যামোনিয়া, pH, দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) ইত্যাদি) নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে যা মাছচাষের স্বাভাবিক পরিবেশের বিঘ্ন ঘটায়।

শীতকালে অনেক মৎস্য খামারী মাছ চাপে রাখা বা অনেক বেশি সংখ্যক মাছকে অল্প জায়গায় রাখেন। অনেক সময় অধিক ঘনত্বের কারণে পুকুরের মাটি ও পানির গুণগত মান (অ্যামোনিয়া, pH, অক্সিজেন ইত্যাদি) বজায় থাকে না। ফলে জলাশয়ের পরিবেশ মাছচাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং রোগের প্রার্দুভাব বেড়ে যায়।এসকল কারণেই সাধারণত শীতকালে মাছ ও চিংড়িতে রোগ-বালাই বেশি হয়ে থাকে।

শীতকালীন মাছ ও চিংড়িচাষে করণীয়

পুকুর বা ঘেরে রোগ জীবাণুর আধিক্য (Pathogenic Load) কমাতে-

  • প্রতি ৩৩ শতাংশ ৩ ফিট পানির জন্য ফাতাহ ২০-২৫ গ্রাম অথবা মিরাস ২০০ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে
  • ৭ দিন পর প্রতি ৩৩ শতাংশ ৩ ফিট পানির জন্য ৩০ গ্রাম হারে হারীয প্রয়োগ করতে হবে
  • ৭ দিন পর পুনরায় প্রতি ৩৩ শতাংশ ৩ ফিট পানির জন্য ফাতাহ ২০-২৫ গ্রাম অথবা মিরাস ২০০ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে

এছাড়াও পুকুর বা ঘেরের মাটি ও পানির গুণগত মান (অ্যামোনিয়া, pH, দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি) নিশ্চিত করার জন্য ৩-৫ ফুট পানির গভীরতায় প্রতি ৩৩ শতকে প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর-

  • ১০০ মিলি তারা এবং/অথবা ৫ কেজি জারফা প্রয়োগ করুন।
  • অথবা, ২-৩ কেজি জামি প্রয়োগ করুন।

মাছের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে-

  • তাযিজ প্রতি কেজি খাদ্যে ২-৩ গ্রাম হারে দিতে হবে।
  • অথবা, ১ কেজি/৩৩ শতক হারে নাবিত পানিতে দিতে হবে।

শীতকালে সাধারণত মাছ ও চিংড়ি কম খাবার খাওয়ার কারণে এদের পুষ্টির চাহিদা ঠিকমত পূরণ হয় না। তাই, শীতকালে মাছ ও চিংড়ির সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিত প্রতি কেজি খাবারে ৫-৭ মিলি হারে মাশা অথবা ১-২ গ্রাম জাহি প্রয়োগ করুন।

মাছের বিপাকক্রিয়া ঠিক রাখার পাশাপাশি মাছ ও চিংড়িকে পেটফোলা রোগ, আন্ত্রিক ক্ষতরোগ, লালচে পায়ুপথ ইত্যাদি নানাবিধ রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২-৩ গ্রাম করে সাজি প্রয়োগ করা উচিত।

শীতকালে মাছকে খাবার দেওয়া একেবারে বন্ধ করা উচিত নয়। মাছের খাবার খাওয়ার আগ্রহ বা চাহিদা থাকলে পরিমিত পরিমাণে সুষম খাবার দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খাবারের অপচয় না হয় ।

শীতকালে মাছ ও চিংড়ির খাদ্যে তেল জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে, যেমন সয়াবিন, সরিষার খৈল, তিলের খৈল ইত্যাদি। প্রয়োজনে প্রতি কেজি খাবারে ৫ মিলি হারে নারিকেল তেল দেওয়া যেতে পারে।

শীতকালে মাছের মজুদ ঘনত্ব যথা সম্ভব কম রাখতে হবে।

শীতকালে সাধারণতঃ গাছের পাতা ঝরে পড়ে। এসকল ঝরা পাতা যাতে পুকুরে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি পুকুরের তলায় যাতে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ না জমে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত ।

সর্বোপরি পুকুরের মাটি ও পানির সার্বিক পরিবেশ (অ্যামোনিয়া, pH, অক্সিজেন ইত্যাদি) খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

এভাবে শীতকালীন সময়ে আমাদের মাছ ও চিংড়ি চাষে সচেতন ও যত্নবান হতে হবে। এর ফলে মাছ ও চিংড়িকে রোগমুক্ত রাখা সম্ভব হবে এবং মৎস্য চাষে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যাবে।