জলাশয়ের অ্যামোনিয়াঃ মৎস্যচাষের প্রধান সমস্যা

মাছ ও চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল জলাশয়ে মাটি ও পানিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি। জলাশয়ের ক্ষতিকর গ্যাসের মধ্যে অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, কার্বন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন, ক্লোরিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে জলাশয়ে সবচেয়ে সহজলভ্য ও ক্ষতিকর গ্যাস হল অ্যামোনিয়া।

অ্যামোনিয়া তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত রংবিহীন একটি গ্যাস। এটি সাধারণত জলাশয়ের পরিবেশগত অবস্থা নির্দেশ করে। পুকুরে অব্যবহৃত খাবার, মাছের ত্যাগকৃত মল-মূত্র, অতিরিক্ত মিউকাস (পিচ্ছিল পদার্থ) এবং গাছের পাতাসহ নানাবিধ জৈব পদার্থ পঁচে পুকুরের তলদেশে অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি হয়।

মাছচাষের জন্য আদর্শ অ্যামোনিয়ার মাত্রাঃ ≤ ০.২৫ পিপিএম

অ্যামোনিয়া ২ প্রকারে থাকে- অ্যামোনিয়া গ্যাস (NH3) ও অ্যামোনিয়াম আয়ন (NH4+)। সাধারণত NH4+ এর তুলনায় NH3 এর বিষাক্ততার মাত্রা অনেক বেশি।

পুকুরে পানির তাপমাত্রা ও pH বেড়ে গেলে অ্যামোনিয়ার বিষাক্ততা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে তীব্র গরমে মাছ ও চিংড়িতে অ্যামোনিয়াজনিত ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হয়। শীতকালে পানির তাপমাত্রা কম থাকায় pH ও সাধারণত কম থাকে। এজন্য শীতকালে কোন কারণে জলাশয়ে অ্যামোনিয়া বেশি হলে অ্যামোনিয়ার বিষাক্ততা কম দেখা দেয়। ফলে শীতকালে জলাশয়ে তাপমাত্রা কম থাকায় অ্যামোনিয়াজনিত ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়।

নাইট্রোজেন চক্র বা অ্যামোনিয়া চক্র একটি চলমান প্রক্রিয়া। একারণে চাষের পুকুরে সবসময় কম-বেশি অ্যামোনিয়া গ্যাস পাওয়া যায়। এই চক্রাকার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন নাইট্রিফাইং ও ডি-নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া অংশগ্রহণ করে। এসকল ব্যাকটেরিয়ার অ্যামোনিয়াকে ভাঙ্গার জন্য প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। পুকুরে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে একারণেই পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা বা ঘাটতি দেখা দেয়।

পুকুরে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যা
মাছের শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, ফলে মাছ পানিতে এলোমেলোভাবে ঘুরতে থাকে।
মাছের ফুলকা ফুলে একে অপরের সাথে লেগে যায়, ফলে ফুলকা বন্ধ হয়ে মাছ মারা যেতে পারে।
পুকুরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।
পুকুরে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া হলে মাছ খাওয়া ছেড়ে দেয়।
পুকুরে ঘনঘন অ্যামোনিয়াজনিত বিষক্রিয়া হলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
মাছের ত্বক, ফুলকা, চোখ, পাখনা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন- কিডনী, যকৃৎ, অন্ত্র ইত্যাদি দুর্বল হয়ে পড়ে।
মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে বিভিন্ন পরজীবী ও রোগজীবাণুর আক্রমণ বেড়ে যায়।

জলাশয়ে অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণের উপায়

জলাশয়ের অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসসমূহ দূর করতে প্রতি ৩৩ শতাংশে ৩-৫ ফুট পানির জন্য ১০০ মিলি তারা ও ৬ কেজি জারফা ব্যবহার করা উচিত। তারা-তে উপস্থিত ইউকা নির্যাসে পর্যাপ্ত পরিমাণে Saponin steroid & Glycocomponent থাকে যা উপরোক্ত গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ করে পুকুরের পরিবেশ মাছচাষের উপযোগী করে তোলে। জারফা বিভিন্ন প্রাকৃতিক জিওলাইটের মাধ্যমে পুকুর বা ঘেরের তলদেশের জৈব বর্জ্য শোধন করে। ফলে মাটি ও পানির দূর্গন্ধ দূর হয় এবং পুকুরে pH এর ভারসাম্য বজায় থাকে। এছাড়াও পুকুরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের যোগান নিশ্চিত করার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাবার ও দ্রবীভূত অক্সিজেন তৈরি হয়।

পুকুরের পরিবেশ মাছচাষের উপযোগী রাখতে প্রতি ৩৩ শতকে ৩ ফিট পানির জন্য পুকুর প্রস্তু‘তির সময় ২.৫-৩ কেজি জামি এবং চাষকালীন সময়ে ২ কেজি জামি প্রতি ১৫ দিন পর পর ব্যবহার করতে হবে। জামি-তে জিওলাইট ও ইউকার পাশাপাশি Bacillus subtilsBacilus licheniformis রয়েছে, যা জলাশয়ের বিভিন্ন জৈব পদার্থকে ভেঙ্গে নাইট্রোজেন চক্রের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে মুক্ত করে দেয়। এতে পুকুরের ক্ষতিকর গ্যাস দূর হওয়ার পাশাপাশি এসব ক্ষতিকর গ্যাসের উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও জলাশয়ের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস ও অণুজীবের বৃদ্ধি রোধ করে। ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং রোগ সংক্রমণের হার হ্রাস পায়।