কার্বন ডাই-অক্সাইডঃ মৎস্যচাষে গুরুত্ব

কার্বন ডাই-অক্সাইড CO2 সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক উপাদান। কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়া সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না, এমন অবস্থায় জলাশয়ের প্রাথমিক উৎপাদন ব্যাহত হয়। মাছের বেঁচে থাকার জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড CO2 অপরিহার্য। CO2 গ্যাস পানিতে তাড়াতাড়ি দ্রবীভূত হতে পারে। পানিতে এ গ্যাসটি মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, বাইকার্বনেট এবং কার্বনেট হিসেবে থাকতে পারে।

জলাশয়ে CO2 এর আদর্শ মাত্রা

জলাশয়ের পানিতে ২ নিযুতাংশ (পিপিএম) CO2 থাকলে মাছের উৎপাদন ভাল হয়। পানিতে CO2 এর মাত্রা ১২ মি.গ্রা/লিটারের (পিপিএম) বেশি হওয়া উচিত নয়। জলাশয়ে CO2 এর পরিমাণ বেশি হলে সাধারণত মাছ ও চিংড়ির শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে।

জলাশয়ে CO2 এর উৎস

জলাশয়ে CO2 এর মূল উৎস হলো পানিতে অবস্থিত বিভিন্ন জলজ জীব যেমন মাছ, চিংড়ি, সবুজ শৈবাল, অণুজীব ইত্যাদির শ্বাস-প্রশ্বাস। এছাড়া জৈব পদার্থের পচনের ফলে প্রচুর পরিমাণে CO2 এর তৈরি হয়। পুকুরের তলায় অত্যাধিক জৈব পদার্থ ও কাদা থাকলে অধিক তাপমাত্রায় পুকুরে এ গ্যাসের আধিক্য ঘটে।

জলাশয়ে CO2 এর দিনে-রাতে পার্থক্য

দিনের বেলা সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় জলাশয়ের ফাইটোপ্লাঙ্কটন CO2 কে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য ও দ্রবীভূত অক্সিজেন তৈরি করে। ফলে দিনের বেলা জলাশয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে কিন্তু CO2 অনেক কমে যায়। এই প্রক্রিয়াকে সাধারণত জলাশয়ের শ্বাস গ্রহণ করা বলা হয়। সাধারণত ২৪ ঘন্টায় জলাশয় একবার শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে বলে মনে করা হয়।

অন্যদিকে রাতের বেলা সূর্যের আলো না থাকার কারণে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রাতের বেলা অক্সিজেন তৈরি হয় না। কিন্তু জলাশয়ের মাছ ও চিংড়ি, শৈবাল, তলদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণী ইত্যাদি শ্বসন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং CO2 ত্যাগ করে। ফলে রাতের বেলা জলাশয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে কিন্তু CO2 এর পরিমাণ বেড়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে সাধারণত জলাশয়ের শ্বাস ত্যাগ করা বলা হয়।

সুতরাং, জলাশয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এবং CO2 এর পরিমাণ পরস্পরের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ জলাশয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়লে CO2 এর পরিমাণ কমে, আবার দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমলে CO2 এর পরিমাণ বাড়ে।

জলাশয়ে CO2 এর প্রভাব

জলাশয়ের পানিতে CO2 এর পরিমাণ কমে গেলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। এতে মাছের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয় না। আবার CO2 এর পরিমাণ অত্যাধিক বৃদ্ধি পেলে পানির অম্লত্বের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পানির অম্লত্বের মাত্রা বেড়ে গেলে জলাশয়ের পিএইচ (pH) কমে যায়। ফলে প্রাথমিকভাবে প্রচুর প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হলেও মাছের খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা ও চাহিদা হ্রাস পায় এবং এর ফলে মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন হ্রাস পায়।

মাছ শ্বসনের ফলে তার শরীরে তৈরি CO2 সাধারণত ফুলকার সাহায্যে বের করে দেয়। কিন্তু জলাশয়ে CO2 এর পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে গেলে মাছ তার শরীর থেকে CO2 বের করে দিতে পারে না, ফলে মাছের শরীরের রক্তে এই CO2 মিশে যায়। তখন মাছের শরীরে হিমোগ্লোবিনের কার্যকারিতা কমে যায় এবং রক্তে অক্সিজেন দ্রবীভূত হতে পারে না। ফলে মাছ ও চিংড়ির শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি মাছ ও চিংড়ি মারা যেতে পারে।

সাধারণভাবে মাছ ও চিংড়িতে CO2 এর বিষাক্ততা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব বেশি হলে CO2 এর বিষাক্ততা কম হয়ে থাকে, পক্ষান্তরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব কম হলে CO2 এর বিষাক্ততা বেশি হয় ।

জলাশয়ে CO2 নিয়ন্ত্রণের উপায়
জলাশয়ে CO2 এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়-
মাছ ও চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে
সার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে
পুকুরের গভীরতা কমিয়ে
নিয়মিত হররা টেনে

এছাড়াও পানিতে ১.০ নিযুতাংশ (পিপিএম) হারে দাবির প্রয়োগ করলে প্রায় ১.৫ নিযুতাংশ (পিপিএম) হারে CO2 কমে যায়। অর্থাৎ, প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০ গ্রাম করে দাবির প্রয়োগের মাধ্যমে জলাশয়ের CO2 নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ৩৩ শতাংশ জলাশয়ে ৩-৫ ফিট গভীরতার জন্য ১৭০-২০০ গ্রাম হারে আজলা প্রয়োগ করলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে CO2 কমে যায়।

জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য ৩৩ শতাংশে ৩-৫ ফিট গভীরতার জন্য ৪-৬ কেজি হারে জারফা, ১০০ মিলি হারে তারা এবং ১০০ গ্রাম হারে হারীয প্রয়োগ করা যায়। এভাবে জলাশয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে CO2 নিয়ন্ত্রণ করা যায়।