গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম সঠিক নিয়মে পুকুর প্রস্তুতি এবং পোনা মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এ পর্বে আমরা আলোচনা করব পোনা মজুদ পদ্ধতি, পোনার প্রজাতি নির্বাচন ও মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ এবং পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
ক) পোনা মজুদ পদ্ধতি
বড় মাছ উৎপাদনের জন্য পুকুরে চারা পোনা মজুদ করতে হবে। হ্যাচারিতে ডিম থেকে মজুদ পুকুরে চারা পোনায় রুপান্তরিত হতে ৫২-৭৮ দিনে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। পর্যায়গুলো নিম্নরূপঃ
১। ডিম পোনাঃ হ্যাচারিতে ডিম থেকে জন্মের পর ২-৩ দিন পর্যন্ত পোনাকে ডিম পোনা বলা হয়। এদের আকার ০.১-০.২ সেমি পর্যন্ত হয়। পেটের নিচে একটি খাদ্য থলি থাকার কারনে এরা এসময় বাইরের কোন খাবার খায় না।
২। রেণু পোনাঃ ডিম পোনার পেটের খাদ্য থলি শেষ হওয়ার পরবর্তী অবস্থাকে রেণু পোনা বলে। শুরুতে এদের আকার ০.২৫-০.৫ সেমি পর্যন্ত থকে। রেণু পোনা নার্সারী পুকুরে মজুদ করা হয় এবং এরা পানিতে ভাসমান ছোট জুওপ্লাংকটন (বিশেষত রটিফার), সেদ্ধ ডিমের কুসুম ইত্যাদি খায়।
৩। ধানী পোনাঃ রেণু পোনা আরো বড় হয়ে আকারে ২-৩ সেমি হলে তাদের ধানী পোনা বলে। রেণু পোনা থেকে ধানী পোনা হতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। ধানী পোনা লালন পুকুরে মজুদ করা হয় এবং এরা পানিতে ভাসমান জুওপ্লাংকটন খায়।
৪। চারা পোনাঃ ধানী পোনা বড় হয়ে আকারে ৭-১৫ সেমি বা ওজনে ১০-৩০ গ্রাম হলে এদেরকে চারা পোনা বলে। আকৃতিতে হাতের আঙ্গুলের মত হওয়ায় এদের আঙ্গুলী পোনাও বলা হয়। ধানী পোনা থেকে চারা পোনা হতে ৪০-৬০ দিন সময় লাগে। চারা পোনা স্থানান্তর করে মজুদ পুকুরে রাখা হয়।
পোনা উৎপাদনের জন্য প্রধানত দুই ধরনের পুকুর ব্যবহার করা হয়। যথা-
১। নার্সারী পুকুরঃ যে পুকুরে রেণু পোনা ছেড়ে ধানী পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাকে নার্সারী পুকুর বলে। আদর্শ নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে ও গভীরতা হওয়া উচিত ২.৫-৩.৫ ফুট এবং তলায় নূন্যতম ৫-৭ সেমি কাদা থাকা উচিত।
২। লালন/চালাই পুকুরঃ যে পুকুরে রেণু পোনা বা ধানী পোনা ছেড়ে চারা পোনা পর্যন্ত বড় করা হ্য় তাকে লালন পুকুর বা চালাই পুকুর বলে। লালন পুকুরের আয়তন ২০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, গভীরতা হওয়া উচিত ৩.৫-৫ ফুট এবং এবং তলায় নূন্যতম ৭-১০ সেমি কাদা থাকা উচিত।
খ) পোনার প্রজাতি নির্বাচন ও মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ
প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন এবং মাটি ও পানির গুণগত মান, অর্থাৎ উর্বরতা শক্তির উপর নির্ভর করে একই পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থাকতে পারে। প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদনের ভিত্তিতে পুকুরে তিনটি স্তর বিবেচনা করা যায়। পুকুরের পানির সব থেকে উপরে থাকে উপরের স্তর। এখানে প্রচুর পরিমানে ফাইটোপ্লাংকটন থাকে। কাতল, সিলভার কাপ, ব্রিগহেড ইত্যাদি মাছ এই স্তরে থাকে। উপরের স্তরের পরবর্তী স্তরটি হল মধ্য স্তর। এখানে ফাইটোপ্লাংকটন ও জুওপ্লাংকটন উভয়ই থাকে। রুই, গ্রাস কার্প, বাটা মাছ ইত্যাদি মধ্য স্তরে থাকে। পুকুরের মধ্য স্তরের পরে সব থেকে নিচে থাকে নিম্ন স্তর । এখানে ফাইটোপ্লাংকটনের চেয়ে জুওপ্লাংকটনই বেশি থাকে। মৃগেল, শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, শোল ইত্যাদি মাছ নিম্ন স্তরে থাকে। এছাড়া কিছু কিছু মাছ রয়েছে যারা পুকুরের সকল স্তরে বসবাস করতে পারে এবং ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটন উভয়ই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। যেমন- তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, সরপুঁটি, মলা ইত্যাদি।
পুকুরের উপরের স্তর, মধ্য স্তর এবং নিম্নস্তর, এই তিনটি স্তর বিবেচনা করে মাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে এবং ১:১:১ অনুপাতে পোনা ছাড়তে হবে। পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে বিভিন্ন প্রজাতির পোনার আকার সমান হলে ভাল হয়। পুকুরের উর্বরতা শক্তি, আয়তন, গভীরতা ও ব্যবস্থাপনা সাপেক্ষে পোনার সংখ্যা কিছু কম-বেশী হতে পারে। কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে পোনা মজুদের জন্য নিম্নে বর্ণিত মডেলগুলো অনুসরণ করে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবেঃ
প্রজাতি | পানির স্তর | প্রতি শতাংশে মজুদ ঘনত্ব | ||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মডেল ১ | মডেল ২ | মডেল ৩ | মডেল ৪ | মডেল ৫ | মডেল ৬ | মডেল ৭ | ||
কাতল | উপরের স্তর | ৫-৮ | – | ৫-৮ | – | – | ১০ | ১৩ |
সিলভার কার্প | উপরের স্তর | ১৫-১৮ | – | ১০-১২ | – | – | – | – |
ব্রিগহেড কার্প | উপরের স্তর | ১০-১৩ | ১০ | – | – | – | ৫ | ৭ |
রুই | মধ্য স্তর | ১০-১৩ | – | ৮-১০ | – | – | ৫ | ৭ |
মৃগেল | নিম্ন স্তর | ১০-১৩ | – | ৮-১০ | – | – | ৫ | ৭ |
অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছ | নিম্ন স্তর | ১০-১৩ | – | ৮-১০ | – | – | ৫ | ৭ |
থাই সরপুটি | সকল স্তর | – | – | ১৫-২০ | ২০ | – | – | – |
মনোসেক্স তেলাপিয়া | সকল স্তর | – | ৮০ | – | ৮০ | – | ৩০ | ৪০ |
পাঙ্গাশ | সকল স্তর | – | – | – | – | ২০০ | – | – |
মলা | সকল স্তর | – | ১০০ | – | – | – | – | – |
মোট | ৬০-৭৮ | ১৯০ | ৫৪-৭০ | ১০০ | ২০০ | ৬০ | ৮১ |
এখানে উল্লেখ্য যে, যেসব পুকুরে সারাবছর কমপক্ষে ৩ ফুট পানি থাকে সেসব পুকুরের ক্ষেত্রে মডেল ১, মডেল ২, মডেল ৬ ও মডেল ৭ অনুসরণ করতে হবে। মৌসুমী পুকুরের ক্ষেত্রে মডেল ৩ অনুসরণ করতে হবে। মডেল ৪ উপকূলীয় এলাকায় লোনা পানির পুকুরের ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে। মডেল ৫ শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য যাদের খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ্য আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
গ) পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
১। পুকুর ব্যবস্থাপনাঃ পোনা ছাড়ার পর পুকুরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ১৫ দিন পর পর শতাংশে ১০০-৫০০ গ্রাম জামি অথবা ২-৩ মিলি তারা ব্যবহার করতে হবে। পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ১৫-২০ দিন পর পর প্রতি একরে ১০ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি, ৫ কেজি হিসান এবং ১০০ গ্রাম হারীয প্রয়োগ করতে হবে।
পুকুরের মাটি ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য ১ মাস পর পর প্রতি ৩৩ শতাংশে ৫ কেজি জারফা এবং ২৫-৩০ গ্রাম হারীয প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও পুকুরে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রতি ৩৩ শতাংশে ৩-৫ ফুট পানির জন্য ২৫ গ্রাম হারে ফাতাহ প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা রোধে একর প্রতি ৫০০-৬০০ গ্রাম হারে আজলা প্রয়োগ করতে হবে।
২। খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ পোনা মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক সুষম খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগ কম-বেশী হতে পারে। সাধারনত প্রতি ১০০ কেজি মাছের জন্য ৩-৫ কেজি হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। তবে পাঙ্গাস মাছের পোনার ক্ষেত্রে খাদ্যের পরিমান বেশী লাগবে। নিচের ছক অনুসারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে-
পোনা মাছের পর্যায় | দৈনিক খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা | |
---|---|---|
পাঙ্গাস মাছ | অন্যান্য সকল মাছ | |
১ম মাস | দৈহিক ওজনের ২০% | দৈহিক ওজনের ৫% |
২য় মাস | দৈহিক ওজনের ১৫% | দৈহিক ওজনের ৪% |
৩য় মাস থেকে মাছ আহরণ পর্যন্ত | দৈহিক ওজনের ৫% | দৈহিক ওজনের ৩% |
হাতে তৈরি সুষম সম্পূরক খাদ্যের ক্ষেত্রে, প্রতি ১০০ কেজি পোনা মাছের খাদ্য উৎপাদন করতে বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার মাত্রা নিম্নরূপ-
খাদ্য উপাদান | পরিমাণ (কেজি) |
---|---|
গমের ভূষি | ২৫ |
চালের কুড়াঁ | ৩০ |
সরিষা/তিলের খৈল | ২৫ |
ফিশমিল/প্রোটিন কনসেন্ট্রেট | ১০ |
আটা | ৫ |
চিটাগুড় | ৪.৫ |
ভিটামিন ও খনিজ লবণ | ০.৫ |
মোট | ১০০ |
এছাড়াও মাছের সঠিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি কেজি খাদ্যে ৫-৭ মিলি মাশা এবং ২-৩ গ্রাম তাযিজ মিশ্রিত করে খাওয়াতে হবে। বিভিন্ন কোম্পানীর বাজারজাতকৃত কৃত্রিম খাদ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন খাদ্যের কাঁচামাল উন্নত ও সঠিক পুষ্টিমান সম্পন্ন হয়, প্রাণীজ আমিষের (প্রোটিন) পরিমান বেশী আছে কিনা এবং মাছকে খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ফিশ ওয়েল বা সমজাতীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।
পোনা মাছের পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নির্দেশনা মেনে চলতে হবে-
প্রতিদিনের খাবার ৩ ভাগ করে ২ ভাগ সকাল ৮-১০ টার মধ্যে এবং ১ ভাগ বিকেল ৩-৫ টার মধ্যে দিতে হবে ।
চিংড়ির ক্ষেত্রে উল্টোভাবে সন্ধ্যায় মোট খাদ্যের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ভোরে ১ ভাগ দিতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগের ৩০ মিনিট পর খাদ্য অবশিষ্ট পড়ে আছে দেখলে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। পরিমানের থেকে বেশি খাবার দিলে অব্যবহৃত খাদ্য পঁচে পুকুরে পানি ও মাটি দূষিত হয়। মাটি ও পানির গুণগতমান ভাল রাখার জন্য ১ মাস অন্তর প্রতি ৩৩ শতকে ৫ কেজি জারফা’র সাথে ৫০ মিলি হারে তারা মিশ্রিত করে ব্যবহার করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগের ৩০ মিনিটের মধ্যেই সব খাদ্য শেষ হয়ে গেছে দেখলে খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
বৃষ্টি হলে খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে।
এছাড়াও পুকুরে পোনা মাছের বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা জানার জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছের বৃদ্ধি কম হলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বি.দ্রঃ পরবর্তী পর্বে আমরা রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা এবং মাছ আহরণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।