মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতকালীন ও পোনা মজুদকালীন করণীয়

মাছ চাষে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক বড় বড় দেশের তুলনায় বেশি। বর্তমানে মৎস্য চাষে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। গত ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের উৎপাদন ৪১.৩৪ লক্ষ মেট্রিক টন। যদিও আমরা উন্নত দেশের মত মাছ চাষে এখনও অত্যাধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করতে পারি নাই। মৎস্য অধিদপ্তরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মৎস্যচাষী ভাইদের নিরলস প্ররিশ্রমে আধুনিক মাছ চাষের সম্ভাবনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৎস্যচাষীগণ পুকুরে মাছ চাষ করে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারেন, পুকুরে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন, পুকুরে মাছ চাষের ফলে এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেন ও উৎপাদিত মাছ বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারেন।

চাষী ভাইদের সুবিধার্থে আমরা মাছ চাষের প্রতিটা ধাপ ইনতেফা বার্তায় প্রকাশ করব। এরই ধারাবাহিকতায়, এই পর্বে আমরা মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতকালীন ও পোনা মজুদকালীন করণীয় বিষয়ে আলোচনা করব। সঠিক পদ্ধতিতে পুকুর প্রস্তুত করলে পুকুরের পাড় ভাল থাকে, জাল টানতে ও মাছ আহরণে সুবিধা হয়, মাছের রোগ কম হয় এবং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

একটি আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য
বছরে ৮-১২ মাস পানি থাকতে হবে।
পানির গভীরতা ৪-৬ ফুট হতে হবে।
পুকুরের পাড় গাছপালা মুক্ত হতে হবে।
পুকুরের পাড় পর্যাপ্ত উঁচু হতে হবে যাতে বাহিরের পানি কিংবা রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
পুকুরটি আয়তাকার বা বর্গাকার হতে হবে।
পুকুরে কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা সূর্যের আলো পড়তে হবে।
পুকুরের তলায় কাদার পরিমান ৬-৮ ইঞ্চির বেশি হবে না।
পুকুর পাড়ের উচ্চতা ও পুকুরের ঢালের অনুপাত ১ঃ১.৫ হতে হবে।

ক) পুকুর প্রস্তুতি (পোনা মজদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা)

১। আগাছা পরিষ্কার, পাড় ও তলা মেরামত
পুকুর পাড়ের ঝোপ-জঙ্গল ও জলজ আগাছা পরিস্কার করতে হবে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে অর্থাৎ শীতের শেষে পুকুরের তলায় অতিরিক্ত পঁচা ও কালো কাদা উঠিয়ে ফেলতে হবে। ভাঙ্গা পাড় মেরামত ও অসমান তলদেশে সমান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোন ভাবেই বাহিরের অন্য পুকুর থেকে পানি চাষীর পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে। সম্ভব হলে পুকুরের পাড় জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।

২। রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ
পুকুরে রাক্ষুসে মাছ থাকলে তা চাষের মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। তাই পুকুরে পোনা মজুদের পূর্বেই এসব মাছ দূর করা প্রয়োজন। এজন্য প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ১৮-২২ গ্রাম রটে-ফা প্রয়োগ করতে হবে।
রটে-ফা’র কার্যকারীতার মেয়াদ ৭ দিন। তাই রটে-ফা প্রয়োগের পর ৭ দিন পর্যন্ত ঐ পুকুরের পানি পান করা, গোসল ও রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

৩। জারফা/চুন প্রয়োগ
নতুন পুকুরের ক্ষেত্রে বা পুকুর শুকানো সম্ভব হলে শুকনো পুকুরের তলদেশে প্রতি শতাংশে ১-১.৫ কেজি হারে কলিচুন ছিটিয়ে দিতে হবে। নতুন পুকুরে চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পানি দিতে হবে। নতুন পুকুরে পানি দেয়ার ৩-৪ দিন পর ও পুরানো পুকুর প্রস্তুতকালে প্রতি ৩৩ শতাংশে ৬-৮ কেজি হারে জারফা প্রয়োগ করতে হবে। জারফা প্রয়োগে পুকুরের পানি পরিস্কার হয়, ক্ষতিকর গ্যাস ও রোগ-জীবাণু দূর হয় এবং পুকুর অধিক উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে।

৪। ক্ষতিকর গ্যাস দূরীকরণ
পুরানো পুকুরের ক্ষেত্রে, জারফা প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর জামি অথবা তারা প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতাংশে ৩-৫ ফুট পানির জন্য ৩-৫ কেজি জামি অথবা ৫০ মিলি তারা ব্যবহার করতে হবে।

৫। সার প্রয়োগ
পুকুরে নিয়মিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে মাছের জন্য প্রাকৃতিক খাবার তৈরী হয়। পর্যাপ্ত পরিমানে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরীর জন্য জামি অথবা তারা প্রয়োগের ২-৩ দিন পর পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈব সার (হিসান ০.৫-১ কেজি/শতক) ও অজৈব সার (ইউরিয়া ১৫০-২০০ গ্রাম/শতক ও টিএসপি ৭০-১০০ গ্রাম/শতক) এবং প্রতি ৩৩ শতাংশে ৩-৫ ফুট পানির জন্য ৩০ গ্রাম হারীয প্রয়োগ করতে হবে। হারীয প্রয়োগের ফলে পুকুরের পরিবেশ মাছ চাষের জন্য উপযোগী হবে, উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূর হবে। হারীয প্রয়োগের ২ দিন আগে ও প্রয়োগের ৭ দিন পর্যন্ত কোন প্রকার জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যাবে না।

৬। প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা
পুকুরের পানির রং সবুজ বা বাদামি হলে বুঝতে হবে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়েছে। সূর্যের দিকে মুখ করে হাত কনুই পর্যন্ত ডুবানোর পর যদি হাতের তালু দেখা না যায় তবে বুঝতে হবে পরিমিত খাদ্য আছে। এছাড়াও পানিতে সেক্কি ডিস্ক ব্যবহার করে প্রাকৃতিক খাদ্য পরিমাপ করা যায়।

 
৭। পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা ও অক্সিজেন বৃদ্ধি
পোনা ছাড়ার ১-২ দিন পূর্বে পুকুরে হাপা (ছোট মশারীর জাল) স্থাপন করে ১০-১৫ টি পোনা ছেড়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পোনা মারা গেলে বুঝতে হবে পানিতে বিষাক্ততা রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিমানমত আজলা, জারফাতারা প্রয়োগ করতে হবে। ৩-৪ দিন পর পানি আবার পরীক্ষা করে তারপর পোনা ছাড়তে হবে। এছাড়াও মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের অক্সিজেন বৃদ্ধিতে, প্রতি ৩-৪ ফুট পানির গভীরতায় প্রতি একর পুকুরের জন্য ২৫০-৩০০ গ্রাম আজলা প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে মাছ ছাড়ার পূর্বে পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমান অক্সিজেন থাকবে।

খ) পোনা মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা

১। ভাল পোনা নির্বাচন
পুকুরে চাষের জন্য ভাল মানের পোনা ক্রয় করতে হবে।
এজন্য বিশ্বস্ত নার্সারীর নিকট হতে পোনা ক্রয় করতে হবে।
সুস্থ্য পোনা স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করবে।
মাছের ফুলকা লাল ও চকচক করবে।
চোখ উজ্জ্বল ও পরিস্কার দেখাবে।
সুস্থ্য পোনা উজ্জ্বল চকচকে দেখাবে এবং
গামলা বা বালতির পানিতে স্রোতের বিপরীতে চললে বুঝতে হবে সেটি ভালো মানের পোনা।

 
২। পোনা পরিবহন
অল্প দূরত্বে বড় পরিস্কার প্লাস্টিকের ড্রামে পোনা পরিবহণ করা যাবে।
পরিবহনের পূর্বে পোনাকে পাকা করে নেয়া হয়েছে কি না তা জেনে নিতে হবে। পোনা পাকা করা থাকলে মৃত্যুহার কম হবে।
পরিবহনের সময় পোনা ও পানির অনুপাত ঠিক রাখতে হবে এবং মাঝে মাঝে পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে।
পরিবহনে ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে ভিজা পাটের চট জড়িয়ে রাখতে হবে যাতে পানি গরম না হয়।
প্লাস্টিক পাত্রে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য পানির ঝাপটা বা পরিমানমত আজলা ব্যবহার করতে হবে।
বেশি দূরত্ব হলে অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহন করা উচিত।
পরিবহনজনিত ধকল কাটানোর জন্য পলিথিন ব্যাগের বা পাত্রের প্রতি লিটার পানিতে ০.৫-১ গ্রাম হারে তাযিজ প্রয়োগ করতে হবে।


৩। পোনা মজুদকালীন করণীয়
পুকুরের পানিতে ভালভাবে খাপ খাওয়ানোর পর পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা পরিবহন করে নিয়ে আসার পর পোনার পাত্র বা ব্যাগ পুকুরের পানিতে ঘন্টা খানেক রাখতে হবে, যাতে পুকুরের পানির তাপমাত্রা ও পোনার পাত্রের বা ব্যাগের পানির তাপমাত্রা একই হয়।
তারপর পুকুরের পানি অল্প অল্প করে পোনার পাত্রে প্রবেশ করাতে হবে এবং পাত্র আস্তে আস্তে কাত করে রাখতে হবে, যাতে পোনা নিজে নিজে পুকুরে চলে যায়।
পরিবহনজনিত ধকল কাটানোর জন্য পুকুরে প্রতি শতাংশে ৩-৫ ফুট পানির জন্য ৫ গ্রাম হারে তাযিজ প্রয়োগ করতে হবে।

বি.দ্রঃ পরবর্তী পর্বে আমরা পোনা মজুদের ঘনত্ব, মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করব।