জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, বৃষ্টিপাতের বিন্যাস-এ আমূল পরিবর্তন এসেছে, ফলে এবছর আষাঢ় শ্রাবণ মাসেও কৃষকদের সেচ দিয়ে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করতে দেখা গেছে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লক্ষ হেক্টর উপকূলীয় অঞ্চল, এর মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। তার মধ্যে ৬.৫ লক্ষ হেক্টর বৃহত্তর খুলনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলায়, এছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুর জেলায় লবণাক্ততা রয়েছে।
সাধারনত ০-২ ডিএস/মিটার মাত্রার মাটিকে লবণাক্তশুন্য মাটি বলা হয়। এছাড়া ২-৪, ৪-৮, ৮-১৫ ও ১৫ ডিএস/মিটার এর অধিক মাত্রাকে যথাক্রমে স্বল্প, মধ্যম, লবণাক্ত ও অভিমাত্রার লবণাক্ত মাটি বলা হয়। বর্তমানে উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলসহ সারাদেশের আমন ধান উৎপাদন এর জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো কৃষক ভাইয়েরা গ্রহণ করতে পারে।
সম্পূরক সেচ
আমন চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টি নির্ভর। তবে আমনের বৃষ্টিপাত সময়মত না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টি-নির্ভর ধানের জমিতে যেকোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে লবণাক্ত অঞ্চলে অবশ্যই স্বাদু পানি দিয়ে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূরক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
এছাড়া আবাদী জমির এক কোনায় গর্ত বা ছোট পুকুর (যা মূল জমির শতকরা ৫ ভাগ) করে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পরবর্তীতে রবি মৌসুমে মাদা জাতীয় সবজি যেমন তরমুজ, কুমড়া ইত্যাদি চাষে ব্যবহার করা
যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা
মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। তবে লবণাক্ত এলাকায় রোপনকৃত জমিতে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-টিএসপি- এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৩-৯-১৩-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত টিএসপি – এমওপি জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতেঃ ১ম কিস্তি চারা রোপনের ৭-১০ দিন। পর, ২য় কিস্তি চারা রোপনের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
ডিএপি সার ব্যবহার করলে শতকরা ৪০ ভাগ ইউরিয়া কম ব্যবহার করলেই হবে। দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক ফলন পেতে জমি তৈরীর সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে বিঘা প্রতি ৬০ কেজি জৈব সার এবং শেষ চাষের সময় ১ কেজি টোপাজ, ১.৫-২ কেজি বোর-ফা, ২-৩ কেজি ম্যাগ-ফা এবং ৩-২০ কেজি (এলাকাভেদে) মোনিফা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ধানের চারা লাগানোর ১৫-২৫ দিনের মধ্যে প্রথমবার ইউরিয়া প্রয়োগের সময় বিঘা প্রতি ১ কেজি সাহার প্রয়োগ করলে ধানের কুশি বৃদ্ধি পায় এবং পাতা গাঢ় সবুজ হয়। অন্যদিকে ডিএপি ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব। টোপাজ বা টোপাজ হেপ্টা ফসফরাস জাতীয় সারের সঙ্গে একত্রে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এ সমস্যার সমাধান হলো জিংক সারের সর্বশেষ প্রযুক্তি ইনতেফার টোপাজ চিলেটেড প্লাস। ধানের শীষ ৫-১০% বের হলে ৪৮-৬৪ লিটার পানিতে ৪ প্যাকেট টোপাজ চিলেটেড প্লাস মিশিয়ে ধান গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এতে ধানের ফলন বিঘা প্রতি প্রায় ২-৩ মণ বৃদ্ধি পাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
ধানের অন্যতম শত্রু হলো আগাছা । ধানক্ষেত রোপনের পর ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে। আগাছা আলো, পানি ও খাদ্য উপাদানের জন্য ধান গাছের সাথে প্রতিযোগিতা করে । এছাড়াও আগাছা রোগ-জীবাণু ও পোকা মাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। ধানের বিভিন্ন ধরনের আগাছা দমনের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে ১৩৩ মিলি সিলাহ চারা রোপনের ৩-৫ দিনের মধ্যে স্প্রে করতে হবে। অথবা ধানের চারা রোপনের ৭-১২ দিনের মধ্যে (এলাকাভেদে) ৫০-১০০ গ্রাম শাবিল অথবা ২০-২৫ গ্রাম লুবাদা প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
আমন ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। এলাকাভেদে আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, পামরি পোকা ইত্যাদি।
ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে । প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে রোপা আমন মৌসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে।
ধানের মাজরা পোকা দমনের জন্য প্রতি বিঘায় ৫০ গ্রাম বাতির চারা রোপনের ১৫-২৫ দিনের মধ্যে প্রথমবার সারের সাথে এবং ৪০-৫০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বাদামী গাছ ফড়িং (কারেন্ট পোকা) দমনের জন্য পোকার আক্রমণের পূর্বে বা পোকার আক্রমণ দেখা মাত্র প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম সাবা মিশিয়ে সমস্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ধানের অন্যান্য পোকাসমূহ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি জুবাস অথবা ১.৫-২ মিলি জাহিম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, ব্লাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পঁচা, টুংরো, বাকানি এবং লক্ষ্মীরগু (False smart) সচরাচর দেখা যায়।
খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনো পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। ধানের খোলপোড়া, খোল পঁচা ও লক্ষীরগু রোগ দমনের জন্য ১৬ লিটার পানিতে ১৩ মিলি তারেদ মিশিয়ে থোড় অবস্থায় ১ম বার এবং শীষ আসার পর ২য় বার স্প্রে করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য ধানের পাতায় চোখের মত দাগ দেখা মাত্রই বিঘা প্রতি ৫০ গ্রাম দিফা স্প্রে করতে হবে।
পাতা ঝলসানো বা বিএলবি রোগ দমনের জন্য বিঘা প্রতি ২০০ গ্রাম রাদি থোড় অবস্থা হলে ১ম বার এবং ধানের শীষ আসার পর ২য় বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ৩-৫ গ্রাম রিফা মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ মৌসুমে সকল সুগন্ধি ধানে নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে ঘোড়ের শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক যেমন দিফা অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে।
দ্রুত মাড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ও মিনি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভাল ফলন পেতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। আমন মৌসুমে নিজের বীজ নিজে রেখে ব্যবহার করাই উত্তম । এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালোভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে।
মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরণ, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও গুপ্ত এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে।