আদা’র উৎপাদন প্রযুক্তি

আদা একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল, যা প্রধানত রান্না ও ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। আদা’র সঠিক উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ করলে ফসলের ফলন ও মান উন্নত করা যায়। নিচে আদা’র উৎপাদন প্রযুক্তি বর্ণনা করা হলোঃ
জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি
ভালো পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা। দোঁ-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি আদা চাষের জন্য উপযোগী। জমি ভালোভাবে চাষ করে আগাছামুক্ত ও মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে।
চাষাবাদের সময়/বীজ বপনের সময়
এপ্রিল থেকে মে মাসে আদা বপন করা যায়। তবে এপ্রিলের শুরুতে আদা লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
বীজ আদা নির্বাচন
ভালো মানের, রোগমুক্ত ২০-৩০ গ্রাম ওজনের টুকরো বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বীজে ১-২টি কুঁড়ি থাকা উচিত। এ আকারের বীজ বপন করলে বিঘা প্রতি ২১০-৩২০ কেজি আদা’র প্রয়োজন হয়।
বীজ শোধন
১০০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম হাদাক ৪৫ ডব্লিউপি মিশিয়ে তার মধ্যে ১০০ কেজি আদা ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করতে হবে। এ বীজ ছাঁয়াযুক্ত স্থানে খড় বা চট দিয়ে ঢেকে রাখলে ভ্রূণ বের হয় যা জমিতে রোপন করতে হয়।
বীজ বপন
একসারিঃ সারি-সারি= ২০ ইঞ্চি, গাছ-গাছ =২০ ইঞ্চি
দুই সারিঃ এক বেড থেকে দুই সারির দূরত্ব =২০ ইঞ্চি এবং
গাছ-গাছ= ১০ ইঞ্চি, গভীরতা =২.০-২.৫ ইঞ্চি
বীজ আদা রোপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে সব আদার অংকুরিত মুখ একদিকে থাকে। কারণ ৭০-৯০ দিন পর এক পাশের মাটি সরিয়ে পিলাই (বপনকৃত আদা) সংগ্রহ করা যায়। এতে ৬০-৭০% খরচ উঠে আসে।
আদা চাষে সার ব্যবস্থাপনা
কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। বেশি। ফলন পেতে হলে আদা’র জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। আদা’র জন্য প্রতি বিঘা জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সার নিচে দেওয়া হলোঃ




সারের তালিকা


সার ৩৩ শতক বিঘা প্রতি (কেজি)
জৈব সার (হিসান প্লাস) ৬০.০০
ইউরিয়া (মোনিফা ৬৯.৬০
টিএসপি ৬৬.৬০
পটাশ (রিফা) ৩০.৬৯
জিপসাম (জিপ-ফা) ১৪.৫৫
দস্তা (টোপাজ) ১.০০


সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সম্পূর্ণ জৈব, টিএসপি, জিপসাম, দস্তা, অর্ধেক পটাশ ও সকল সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া ও বাকী পটাশ ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও পটাশ ৮০ দিন ও ১০০ দিন পরপর সমান দুই কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ পদ্ধতি: আদার প্রাথমিক বৃদ্ধি ও কুঁড়ি গঠনের সময় সেচ দেওয়া জরুরি।
পরিচর্যাঃ রোপনের ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে আদা’র গাছ বের হবে। আদার বৃদ্ধি ও পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝের মাটি ২-৩ বারে তুলে দিতে হবে। মালচিং করলে ভালো হয়। জমিতে ছায়াদানকারী হিসেবে ধইঞ্চা ও বককুল লাগানো যেতে পারে। আদার জমিতে লাউ, শিম, পটল লাগিয়ে বাড়তি আয় করা যায়।
বালাই ব্যবস্থাপনা
কান্ড ছিদ্রকারী পোকা: কান্ড আক্রমণ করে বলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে উৎপাদন কম হয়। এ পোকার মথ কমলা হলুদ রঙের এবং পাখার উপর কালো বর্ণের ফোটা থাকে। কীড়া হালকা বাদামি বর্ণের। গায়ে সুক্ষ্ম শুং থাকে।
আদা’র কান্ড ছিদ্রকারি পোকা দমনে জাহিম ৫৫ ইসি প্রতি ১৬ লিটার পানিতে ৩২ মিলি মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার ভালোভাবে স্প্রে করুন। স্প্রে করার সময় খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ার মাটি যেন ভিজে যায়। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই ফসল উঠাবেন না। বালাইনাশক স্প্রে করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আদার কন্দ ছিদ্রকারি পোকা দমনে শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি ১.৫-২ কেজি হারে জহর ৩ জিআর প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ
রাইজম রট: Pythium aphanidermatum (পিথিয়াম এফানিডারমেটাম) নামক ছত্রাকের আক্রমণের কারনে এ রোগ হয়। এ রোগ রাইজমে আক্রমণ করে বলে আদা বড় হতে পারে না ও গাছ দ্রুত মরে যায়।
প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে যায় কিন্তু পাতায় কোন দাগ থাকে না। পরবর্তীতে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মরে যায়। রাইজম (আদা) পঁচে যায় ও ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। ভেজা ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বেশী দেখা যায়। বর্ষাকাল বা জলাবদ্ধতা থাকলে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ রোগ বীজ, পানি ও মাটির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
কন্দ পঁচা রোগ দ্বারা আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে জিবাল ৭৭ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে মাটির সংযোগ স্থলে ১৫-২০ দিন অন্তর-অন্তর প্রয়োগ করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

পাতা ঝলসানো রোগ: প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। এসব দাগগুলোর মধ্যে ধূসর বর্ণ হয় এবং চারপাশে গাঢ় বাদামি আবরণ থাকে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে দাগগুলো বড় হতে থাকে এবং একত্রিত হয়ে যায়।
পাতা ঝলসানো রোগ দমনে প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হাসিন ৬৯ ডব্লিউপি বা ০.৫ মিলি সাদিদ ২৫০ ইসি মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পর পর স্প্রে করা যেতে পারে।
পিলাইতোলা: আদা রোপনের পর গাছ ও শিকড় গজিয়ে গেলে বীজ আদা তুলে নেওয়া যায়। বীজ আদা বিক্রি করে আর্থিক লাভবান হওয়া যায়। একে পিলাইতোলা বলে।
আদা সংগ্রহঃ মাঘ-ফাল্গুন মাস। কন্দ রোপনের (৯-১০) মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে সংগ্রহ করতে হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কোদাল দিয়ে মাটি আলাদা করে আদা উত্তোলন করা হয়। সংগ্রহের পর মাটি পরিষ্কার করা হয়। বিঘা প্রতি ফলন গড়ে ৩.৯৬-৪.৬২ টন।
সংরক্ষণঃ সংগ্রহের পর বড় আকারের বীজ রাইজোম ছায়াযুক্ত স্থানে বা ঘরের মেঝেতে বা মাটির নিচে গর্ত করে গর্তের নিচে বালির ২ ইঞ্চি পুরু স্তর করে তার উপর আদা রাখার পর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এর উপর খড় বিছিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে আদার গুণাগুণ ও ওজন ভালো থাকে। বায়ু চলাচলের জন্য গর্তের উপরিভাগে ও পাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে।

মোঃ সোহেল রানা
অতিরিক্ত কৃষি অফিসার (এল.আর)
প্রশাসন ও অর্থ উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
খামারবাড়ি, ঢাকা