ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে সম্ভাবনাময় সূর্যমুখী-এর উৎপাদন কৌশল

সূর্যমুখী একবর্ষী বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। সূর্যমুখী সাধারণত সব মাটিতেই জন্মে। তবে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে বেশী উপযোগী। আমাদের দেশে বর্তমানে বিভিন্ন জাতের সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে, যার গড় ফলন ১.৫-২ টন/হেক্টর। জাত ভেদে গড়ে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি বীজ প্রয়োজন। সূর্যমুখী সারা বছর চাষ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ মাসের মধ্য থেকে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সূর্যমুখী বীজ সারিতে বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সে.মি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৫ সে.মি. অনুসরণ করলে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যায়।
মাটি ও বীজ শোধন
মাটি ও বীজ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে মাটি ও বীজ শোধন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ইমিডাক্লোপ্রিড ও থিরাম সমৃদ্ধ ইনতেফা কোম্পানীর হাদাক বেশ কার্যকরী। মাত্র ৮ গ্রাম হাদাক দ্বারা এক কেজি বীজ শোধন করা যায়। এতে জমিতে আশানুরূপ গাছের সংখ্যা পাওয়া যায় এবং ফলন ভালো হয়। একটি বড় ঢাকনাযুক্ত পাত্রে সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে পরিমাণমতো হাদাক মিশিয়ে পাত্রের মুখ বন্ধ করে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে এক দিন রেখে দেবার পর বীজ জমিতে বপন করতে হয়। বীজ জমিতে বপনের আগে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে হাদাক মিশিয়ে মাটি শোধন করে নিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী চাষ করে ভালো ফলনের জন্য নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সার প্রয়োগ মাত্রা (একর প্রতি)
১ হিসান প্লাস ১৮০ কেজি
মোনিফা ৩০-৪০ কেজি
টিএসপি ১৫০-২০০ কেজি
রিফা ৩-৫ গ্রাম/লিটার পানি
জিপ-ফা ৩০-৫০ কেজি
টোপাজ ৩ কেজি
বোর-ফা ৩-৬ কেজি
ম্যাগ-ফা ৬-৯ কেজি

অর্ধেক মোনিফা এবং বাকি সব সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকি অর্ধেক মোনিফা ২ ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ২০-২৫ দিন এবং দ্বিতীয় ভাগ ৪০-৪৫ দিন পর (ফুল ফোটার পূর্বে) প্রয়োগ করতে হয়।
সেচ ব্যবস্থাপনা
সূর্যমুখী ফসলের ফলন বেশী পেতে হলে কয়েক বার সেচ দেয়া প্রয়োজন।

প্রথম সেচ দ্বিতীয় সেচ তৃতীয় সেচ
বীজ বপনের ৩০ দিন পর (গাছে ফুল আসার আগে) বীজ বপনের ৫০ দিন পর (পুষ্পস্তবক তৈরির সময়) বীজ বপনের ৭০ দিন পর(বীজ পুষ্ট হবার আগে)

আগাছা ব্যবস্থাপনা
সূর্যমুখীর বীজ বপনের পরপরই ইনতেফা’র আগাছানাশক দাফা খুব কার্যকর। জমি ও এলাকাভেদে একরে ৪০০-১২০০ মিলি হারে দাফা বিকেল বেলা প্রয়োগ করতে হবে। দাফা- এর ভালো ফলাফলের জন্য জমি ভালোভাবে চাষ করতে হবে এবং জমিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকতে হবে। চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর অতিরিক্ত গাছ থাকলে প্রতি হিলে/গোছায় ১টি করে সুস্থ সবল গাছ রেখে বাকি গাছগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
পাতা ঝলসানো রোগঃ এ রোগে আক্রান্ত পাতায় প্রথমে ধূসর বা গাঢ় বাদামী বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে। পরে দাগ মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। শেষে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়। রোগটি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি তারেদ অথবা ১.৫ গ্রাম হামা মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে রোগের প্রকোপ কমে যাবে। ফসল কাটার পর গাছের পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট করলে বা পুড়িয়ে ফেললে এ রোগের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।
সূর্যমুখীর হোয়াইট মোল্ড রোগঃ পাতার বোঁটায়, কাণ্ডে এবং ফলে পঁচন ও সাদা তুলার মত বস্তু দেখা যায়। আগাম বীজ বপন, সুষম সার ব্যবহার এবং রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করে এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়া এ রোগ দমনের জন্য প্রোপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক সাদিদ প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে সমস্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ডাউনি মিলডিউ রোগঃ সূর্যমুখীর বয়স্ক পাতায় এ রোগ প্রথম দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার গায়ে সাদা বা হলদে থেকে বাদামী রঙের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে এটি অন্যান্য পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগ দমনে ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক কাফা প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে সমস্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
পাতা ও মাথা ছিদ্রকারি পোকাঃ বাড়ন্ত অবস্থায় এ পোকার কীড়া পাতা খায় এবং ফুল খেয়ে নষ্ট করে। এতে পুষ্ট বীজের হার কমে যায়। পোকার উপদ্রবের উপর ভিত্তি করে প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলি শেফা মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
কাটুই পোকাঃ এ পোকা রাতের বেলা সূর্যমুখীর চারা কেটে দেয়। এটি দমনের জন্য বিকেল বেলা জুবাস (প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি) অথবা কাছির (প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি) জমির আইলসহ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আইল স্প্রে করতে হবে কারণ পাশের ক্ষেত থেকে যেন কাটুই পোকা আসতে না পারে।
ফসল তোলা ও বীজ সংরক্ষণঃ
৯০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। বীজ সংরক্ষণের আগে অপরিপক্ক ও ভাঙ্গা বীজ বেছে ফেলতে হবে। মোটা পলিথিন ব্যাগে বা কেরোসিন টিন বা টিনের ড্রামে বীজ সংরক্ষণ করা ভালো। ভেতরে পলিথিন দিয়ে চটের বস্তায় ভালোভাবে শুকানো বীজ প্রতি ৩০ কেজির জন্য ২৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডসহ সংরক্ষণ করলে ৭-৮ মাস পরেও বীজের শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। বর্ষাকালে এক থেকে দু’বার বীজ পুনরায় রোদে শুকিয়ে নেয়া ভালো।

কৃষিবিদ কাজী রমজান আলী
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
ভাঙ্গা, ফরিদপুর