
বিশ্বজুড়ে মড়ক রোগ অন্যতম একটি ক্ষতিকারক রোগ। এ রোগ বাংলাদেশের আলু উৎপাদনের প্রধান অন্তরায়। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে আলুর চাষাবাদ বিস্তারের পাশাপাশি এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর এ রোগের আক্রমণে আলুর ফলন গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ হ্রাস পায়। মড়ক রোগের আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ আলুর জাত, গাছের বয়স, রোগ আক্রমণের সময়, আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ রোগের আক্রমণে আলুর ফলন সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হতে পারে।
মড়ক রোগ বা লেইট ব্লাইট চেনার উপায়
এ রোগের আক্রমণ প্রথমে গাছের গোড়ার দিকে পাতায় ছোপ-ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা বিভিন্ন আকারের দাগ দেখা যায়, যা দ্রুত কালো রং ধারণ করে এবং পাতা পঁচে যায়। সকাল বেলা মাঠে গেলে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডারের মতো জীবাণু দেখা যায়। ঠান্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ দ্রুত পঁচে যায়। এই অবস্থায় ২-৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতের সমস্ত গাছ মরে যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত আলুর গাছে বাদামী থেকে কালচে দাগ পড়ে এবং খাবার অযোগ্য হয়ে যায়।
রোগ বিস্তারে অনুকূল আবহাওয়া
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের যে কোনো সময় নিম্ন তাপমাত্রা (রাতে ১০-১৬ °C এবং দিনে ১৬-২৩ °C) এবং কুয়াশাচ্ছন্ন আর্দ্র আবহাওয়া (আর্দ্রতা ৯০% এর বেশি) এ রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সাথে গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হলে এ রোগ ২-৩ দিনের মধ্যে মহামারী আকার ধারণ করে।
লেইট ব্লাইট বা মড়ক রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়
ক) রোগ হওয়ার পূর্বে করণীয়
আগাম আলু চাষ অর্থাৎ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলুর ওপর রোপন অথবা আগাম জাত চাষের মাধ্যমে এ রোগের মাত্রা অনেকটা কমানো সম্ভব। রোগ সহনশীল জাত যেমন বারি আলু- ৪৬, ৫৩, ৭৭, ৯০, ৯১ ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে। এছাড়া রোগমুক্ত প্রত্যায়িত বীজ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
নিম্ন তাপমাত্রা কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে-সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭-১০ দিন অন্তর মেনকোজেব (কাফা ৮০ ডব্লিউপি) গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
খ) রোগ হওয়ার পর করণীয়
১) আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।
২) নিজের বা পাশ্ববর্তী ক্ষেতে রোগ দেখা মাত্রই ৭ দিন অন্তর আফনা ৫০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
যদি কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া দীর্ঘ সময় বিরাজ করে রোগের মাত্রা ব্যপক হয় সেক্ষেত্রে আফনা ৫০ ডব্লিউপি ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ দিন অন্তর স্প্রে করে গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হলে ৩-৪ দিন অন্তর আফনা ৫০ ডব্লিউপি স্প্রে করতে হবে। ছত্রাকনাশক পাতার উপরে ও নিচে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। সাধারণ স্প্রেয়ারের পরিবর্তে পাওয়ার স্প্রেয়ার ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সতর্কতা
গাছ ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে না করাই ভালো। আর যদি স্প্রে করতেই হয় তাহলে প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে সাবানের গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় হাত মোজা, সানগ্লাস, মাক্স ও অ্যাপ্রোন ব্যবহার করতে হবে।
বিজ্ঞানী মোছাদ্দিকুর রহমান
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
প্রজনন বীজ উৎপাদন কেন্দ্র।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়